ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫

৩০ ফাল্গুন ১৪৩১, ১৪ রমজান ১৪৪৬

আরব নারী বিজ্ঞানী সারা আমিরির মঙ্গলগ্রহে অভিযান

প্রকাশ: ০৮:৩০, ২১ জুলাই ২০২০

আরব নারী বিজ্ঞানী সারা আমিরির মঙ্গলগ্রহে অভিযান

সৈয়দ আবদাল আহমদ*

সফলভাবে শুরু হলো সংযুক্ত আরব আমিরাতের মঙ্গলগ্রহ অভিযান। জাপানের রকেটে করে আমিরাতের মহাকাশযান হোপ গেল সৌরজগতের লাল গ্রহ মঙ্গলের দিকে।  আর এর মাধ্যমে পূরন হতে চলেছে একজন আরব নারী বিজ্ঞানী সারাহ আল আমিরির স্বপ্ন।
হোপ মিশন যখন পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গল অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছে, তখন একইসঙ্গে সবার নজর এই নারী বিজ্ঞানী সারাহ'র দিকে। আরব বিশ্বের নারীদের মধ্যে এক বড় অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন তিনি।

বাংলাদেশ সময় রোববার দিবাগত রাত ৩ টা ৫৮ মিনিটে জাপানের দক্ষিণাঞ্চলীয় তানেগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে আমিরাতের মনুষ্যবিহীন মহাকাশযানটি উৎক্ষেপণ করা হয়। এটাই আরব দুনিয়ার প্রথম মহাকাশ অভিযান। মঙ্গলগ্রহে পৌঁছাতে মহাকাশযানটির সাত মাস সময় লাগবে। এটি মঙ্গলের পরিবেশ ও আবহাওয়া নিয়ে তথ্য পাঠাবে। রয়টার্স,বিবিসি, এপি ও এএফপির খবরে বলা হয়,২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মঙ্গলের কক্ষপথে ঢুকবে হোপ মিশন। আমিরাতে আরবি ভাষায় এই মহাকাশযান 'আল আমল' নামে পরিচিত। বাংলায় নাম আশা। এরপর হোপ দুবছর ধরে ঘুরবে মঙ্গলগ্রহের চারপাশে। লাল গ্রহটির উপরিভাগের আবহাওয়া সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে।

হোপ অভিযানে আমিরাতের বৈজ্ঞানিক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন দেশটির ওই নারী বিজ্ঞানী সারা আল আমিরি। মহাকাশযানটির নিখুঁত উৎক্ষেপনের পর উচ্ছ্বসিত সারাহ বলেন, "তাঁর দেশের ওপর এর প্রভাব অনেকটাই ৫১ বছর আগে ১৯৬৯ সালে আমেরিকার চাঁদে পা রাখার মতো। সেটাও ২০ জুলাই তারিখে হয়েছিল। আমি আনন্দিত আমিরাতের শিশুরা ২০ জুলাই ঘুম থেকে উঠে তাদের নিজস্ব অভিযানটি দেখতে পাবে যা নতুন একটি বাস্তবতা। যা তাদের নতুন কিছুতে উদ্বুদ্ধ করবে।" হোপ মহাকাশযানটি মঙ্গলের পথে পাড়ি দিতে উৎক্ষেপিত হওয়ার এক ঘন্টা আগ থেকেই দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা আলোকমালায় জ্বলে উঠে। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু এই অট্টালিকায় উৎক্ষেপণের প্রতীকী ক্ষণগণনাও করা হয়।

আমিরাতের রাশেদ মহাকাশ কেন্দ্রের পরিচালক ইউসুফ হামাদ আল শাইবানি বলেন,এই অভিযান আমিরাত ও আরব অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক। এতে লাখো কোটি তরুণ স্বপ্ন দেখছে এবং অনুপ্রেরণা পাচ্ছে।

যেকোনো সাফল্য বা অর্জনের মূলে থাকে একটা স্বপ্ন। স্বপ্ন নিয়ে ওয়াল্ট ডিজনির উক্তি হচ্ছে, স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে প্রয়োজন ইচ্ছা, আত্মবিশ্বাস,সাহস আর নিয়মিত কাজ করা। মার্কিন টিভি ব্যক্তিত্ব অপরাহ উইনফ্রের উক্তি হচ্ছে, স্বপ্নের পেছনে ছোটার চেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার আর হতে পারেনা। বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালামের উক্তি হচ্ছে, স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে দেখো,স্বপ্ন হলো সেটাই যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না। সারা আল আমিরি যেনো এই উপদেশগুলো নিজের জীবনে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।
কী তাঁর গল্প? সেটাই শোনা যাক।
১৯৮৭ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে জন্ম সারা আমিরির। বয়স মাত্র ৩২ বছর। মহকাশে যাবার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন একেবারে ছোটবেলায়।
সরাহ আমিরির নিজের মুখেই শোনা যাক, "ছোটবেলায় আমার বয়স যখন ১২ বছর,তখন আমি আমাদের ছায়াপথের সবচেয়ে নিকটতম অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির একটি ছবি দেখেছিলাম। সেই ছবিটি আমাকে সৌরজগত নিয়ে আকৃষ্ট করে। তখনই মহাকাশ প্রকৌশলে উৎসাহী হই। শৈশবে আমার স্বপ্নটি ছিল মহাকাশ থেকে আমি পৃথিবী দেখব। কিন্তু তখন আমাকে সবসময় শুনতে হয়েছে এটা অসম্ভব। কারন আমি এমন একটা দেশে থাকি,যে দেশটা একেবারেই নতুন। আমি কিন্তু স্বপ্নের ব্যাপারে হাল ছাড়িনি। বলতাম,আমি মহাকাশ নিয়েই কাজ করতে চাই। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, আমি কল্পলোকে বা জগতে বাস করছি। কিন্তু আমি আমার লক্ষ্যে অবিচল থাকি।"
সারাহ আমিরি সেকেন্ডারি শেষ করে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব শারজাহে কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তি হন। এরোস্পেস ইন্জিনিয়ারিং পড়ার সখ থাকলেও সে বিষয়টি ওখানে ছিল না। ফলে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। আমিরাতে তখন কোনো মহাকাশ কর্মসূচি ছিল না। ফলে তাকে এমিরেটস ইনস্টিটিউশন ফর এডভান্সড সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে যোগ দিতে হলো। সেখানে কাজ করেন দুবাইস্যাট-১ এবং দুবাইস্যাট-২ প্রকল্পে। এরপর যোগ দেন জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে। ২০১৬ সালে তাকে সায়েন্স কাউন্সিলের প্রধান করা হয়। দেশটি মঙ্গল অভিযান শুরু করলে এরসঙ্গে তাকে জড়িত করা হয়। এখন এই মিশনের তিনি প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। ২০১৭ সালে তাকে আমিরাতের এডভান্সড সায়েন্স বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী করা হয়। ইতোমধ্যে তিনি বৈশ্বিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে ২০১৭ সালে আমেরিকায় যান এবং নাসাসহ বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থাগুলো ঘুরে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
উল্লেখ্য,২০১৮ সালে নাসা সূর্য অভিযানে পাঠায় পার্কার সোলার প্রোবকে। এ অভিযানেও বিজ্ঞানী দলে নেতৃত্ব দেন একজন নারী, ড. নিকোলা ফক্স। তার বয়স যখন ৯ বছর,তখন তিনি লন্ডনের বাসায় বাবার সঙ্গে বসে টেলিভিশনে নীল আর্মস্ট্রংয়ের চাঁদে পা রাখার ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলেন। তখনই তিনি স্বপ্ন দেখেন তিনি মহাকাশ বিজ্ঞানী হবেন। তার স্বপ্নও বাস্তবায়িত হয়। ৪৯ বছর পর নাসায় তাঁর নেতৃত্বেই সূর্য অভিযান হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সের অধ্যাপক।

আর এবার আমিরাতের নারী বিজ্ঞানীর ঘটনাও যেনো নিকোলা ফক্স এর সঙ্গে মিলে গেছে।
আমিরাতের হোপ মহাকাশযান তৈরির বেশিরভাগ কাজ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর ল্যাবরেটরি ফর এটমোসফিয়ারিক এন্ড স্পেস ফিজিক্সে। দুবাইয়ের মোহাম্মদ বিন রসিদ স্পেস সেন্টারেও উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। জাপানিজ রকেট দ্বারা চালিত মহাকাশযানটিতে তিন ধরনের সেন্সর রয়েছে। যার কাজ হবে মঙ্গলগ্রহের জটিল বায়ুমন্ডল পরিমাপ করা। এতে শক্তিশালী রেজুলেশনের একটি মাল্টিব্রান্ড ক্যামেরা আছে যা সুক্ষ্ম বস্তুর ছবি তুলবে। গ্রহটির বায়ুমন্ডলের উপরিভাগ ও নিম্নভাগ পরিমাপ করার জন্য রয়েছে ইনফ্রারেড স্পেকটোমিটার। এটি তৈরি করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি। তৃতীয় আরেকটি সেন্সর গ্রহটির অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন পরিমাপ করবে।
বিজ্ঞানী সারাহ বলেন,এই মিশনের অন্যতম কাজ হচ্ছে, এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কেন মঙ্গলগ্রহের বায়ুমন্ডলে থাকতে পারছ না তা পরিমাপ করা। লাল গ্রহটিতে পৃথিবীর মতোই একসময় নদী সাগর ছিল,পানি ছিল। কিন্তু এখন এটি শুষ্ক ধূলিকণায় পরিণত হয়েছে।যুক্তরাষ্ট্রের সায়েন্স মিউজিয়াম গ্রুপের পরিচালক স্যার ইয়ান ব্ল্যাচফোর্ড বলেন,এরআগে যতগুলো মহাকাশযান মঙ্গলে গেছে সেগুলো ভূতত্ত্বের দিকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু হোপ মিশন সফল হলে জলবায়ু সম্পর্কে সামগ্রিক একটা চিত্র পাওয়া যাবে।
সাত মাস পর হোপ যখন গন্তব্যে পৌঁছবে, তখন সংযুক্ত আরব আমিরাত স্বাধীনতার ৫০ বছর অর্থাৎ সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবে। দেশটি দেখাতে চাচ্ছে ৫০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে এমন চ্যালেঞ্চ নেয়ার ক্ষমতা তাদের আছে।
বিজ্ঞানী সারাহ বলেন,আমিরাতের তরুন বিজ্ঞানীদের জন্য এ মিশন স্পেস ইন্জিনিয়ারিং পেশায় যুক্ত হওয়ার দ্বার খুলে দিয়েছে।
জ্বালানী তেলের ব্যবসা আর যথেষ্ট নয় আমিরাতের। তাদের দৃষ্টি এখন মহাকাশে। শুধু তেলের ওপর নির্ভরশীল না থেকে নতুন কিছুতে সরে আসতে চাচ্ছে দেশটি। যদি এ মিশন সফল হয় তাহলে প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরে এসে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে চায় আমিরাত।
মঙ্গলগ্রহ অভিযান হোপ-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা জানান দিতে চান যে,আট শতাব্দী আগে আরব বিজ্ঞানীরা অনেক উন্নত দেশের চেয়েও অগ্রসর ছিলেন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দিক থেকে তারা ছিলেন সামনের সারিতে। আমিরাতের শাসক উচ্চাকাঙ্খী এই মিশনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অহংকারকে আবারও উদদীপ্ত করতে চান। এর আগে আমিরাত পৃথিবী প্রদক্ষিন করার জন্য রকেট পাঠিয়েছিল।
সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় অবস্থিত সাতটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ফেডারেশন। এটি মরুময় দেশ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। উত্তরে পারস্য উপসাগর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে সৌদি আরব এবং পূর্বে ওমান ও ওমান উপসাগর। ১৯৫০ সালে পেট্টোলিয়াম আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত অনুন্নত এলাকার সমষ্টি ছিল। ১৯৭০ সালের শুরুতে বৃটিশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে আসে। দুবাইয়ে বুর্জ খলিফা পৃথিবীর গগনচুম্বী অট্টালিকা বিশ্ববাসীর চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ৮২ লক্ষ জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্হানীয় ১১ লক্ষ। ভারতীয় ২৬ লক্ষ এবং পাকিস্তানি আছে ১২ লক্ষ। মঙ্গলগ্রহে আমিরাতের হোপ মহাকাশযান যান পাঠানোর এ ঘটনা দেশটির জন্য নতুন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করলো,যা মুসলিম বিশ্বের জন্যও এক বড় অনুপ্রেরণা।
 

লেখকঃ সৈয়দ আবদাল আহমদ সিনিয়র সাংবাদিক,জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক,[email protected]

সিলেট নিউজ ২৪

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন